ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৯/১০/২০২৩ ৩:৪২ পিএম

মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পার হয়ে কক্সবাজারে বানের জলের মতোই পাচার হয়ে আসছে মরণনেশা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। স্থল সীমান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ শিকারের নামে জেলে সেজে জলসীমাও অতিক্রম করছে মাদক পাচারকারীরা। ফলে সড়ক ও জলপথে পাচার হয়ে আসা মাদক উদ্ধারে পুলিশ-র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

চোরাচালান নিরোধ আঞ্চলিক টাস্কফোর্স চট্টগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বিভাগের পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং রেলওয়ে পুলিশের অভিযানে ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১০টি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। একই সময়ে আইস উদ্ধার হয়েছে ৭ কেজি ৪২৫ গ্রাম। সঙ্গে ফেনসিডিলসহ অন্য মাদক তো আছেই।

ইয়াবা-আইস পাচারের শীর্ষ উপজেলা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া। এ ছাড়া বান্দরবানের সীমান্ত উপজেলা আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও আসে মাদক। মাদক পাচারের এসব পথ আটকাতে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে সর্বাধিক ইয়াবা-আইস পাচারকারী জেলা কক্সবাজারে নতুন রেলস্টেশন চালু হতে যাচ্ছে। এটিকে মাদক পাচারের ‘নতুন দুয়ার’ মনে করছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই।

আগামী ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধন করবেন বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। উদ্বোধনের পরদিন থেকে রেলপথে সরাসরি যাত্রী পরিবহন না করলেও আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে যাত্রীসেবা শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। তখন যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি কার্যক্রম শতভাগ সঠিক না হলে ইয়াবা-আইস পাচারের আরেকটি নতুন রুট তৈরি হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই নতুন রেলপথে যাতে মাদক পাচার না হয় সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মত চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক পদস্থ কর্মকর্তার।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে ব্যয় ১০ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকায়। প্রকল্পের মাঝপথে প্রকল্পের অর্থ বাড়ানো হলেও মাদক পাচাররোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রকল্পভুক্ত করা হয়নি। প্রকল্প উদ্বোধনের আগমুহূর্তে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্যে মাদক পাচারে ফাঁকফোঁকর রয়ে যাওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো চিহ্নিত হচ্ছে।

মাদক পাচাররোধে কক্সবাজার রেলস্টেশনে ফাঁকফোঁকর থাকার বিষয়টি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জে কর্মরত একজন পদস্থ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রেলপথ নির্মাণ করছে রেল মন্ত্রণালয়। তাদের কাজ নিয়ে আমার মন্তব্য করা উচিত হবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কক্সবাজার রেলস্টেশনটি আধুনিক হলেও সেখানে যাত্রীদের ব্যাগেজ তল্লাশির জন্য স্ক্যানার-আর্চওয়ে রাখা হচ্ছে না। স্ক্যানার-আর্চওয়ে ছাড়া সব যাত্রী ও তাদের ব্যাগ শতভাগ তল্লাশি করা রেলওয়ে পুলিশের দ্বারা সম্ভব হবে না। কারণ, এতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই সুযোগে মাদক পাচারকারীরা কৌশলে ইয়াবা-আইস নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসলে নির্বিঘ্নে ঢাকা পৌঁছে যাবে। এতে ইয়াবা-আইস পাচার সহজ হবে। এটা বন্ধ করতে হলে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে অবশ্যই বিমানবন্দরের আদলে যাত্রী ও ব্যাগ তল্লাশি করতে স্ক্যানার-আর্চওয়ে স্থাপন করতে হবে। যাত্রীরা স্টেশনের প্রবেশপথে ব্যাগ স্ক্যানিং করবেন এবং আর্চওয়ে পেরিয়ে যাবে। তাহলে মাদক পাচাররোধ করা সহজ হবে। অন্যথায় কঠিন হবে।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সড়কপথে চলাচলরত গাড়ি স্থানে স্থানে তল্লাশির সুযোগ থাকে। কিন্তু রেলপথে সেই সুযোগ কম। রেলওয়ে পুলিশের জনবল বৃদ্ধি, থানা এবং ফাঁড়ির জায়গা রাখা হয়নি প্রকল্পে। ফলে এখন পর্যন্ত পুলিশের জন্য কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়নি। শেষ সময়ে এসে এখন রেলওয়ে পুলিশ জনবল, থানা-ফাঁড়িসহ স্থাপনার বিষয় চূড়ান্ত করার কাজ করছে। অথচ শুরু থেকেই এসব প্রকল্পভুক্ত থাকা দরকার ছিল।’

রেলপথের নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে রেলওয়ে পুলিশ। এই কারণে রেল পুলিশের নিরাপত্তা প্রস্তুতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে মাদক পাচারে শীর্ষস্থানীয় জেলা কক্সবাজারের সঙ্গে নতুন রেলপথ সরাসরি যুক্ত হওয়ায় এই গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এমতাবস্থায় নতুন রেলপথে মাদক পাচার রোধে কক্সবাজার রেলস্টেশনে যাত্রীদের জন্য আর্চওয়ে এবং স্ক্যানার বসানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশ কিছু ভাবছে কি না জানতে চাইলে রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. দিদার আহম্মদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখনও এই বিষয়ে কিছুই ভাবিনি।’

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে। এই রুটে প্রাথমিকভাবে দৈনিক দুই জোড়া ট্রেন চলাচলের ঘোষণাও দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রেলযাত্রীদের নিরাপত্তায় এখনও রেল পুলিশের জনবল কাঠামো, থানা-ফাঁড়ির স্থাপনা চূড়ান্ত হয়নি। থানা-ফাঁড়ি ভবনও নির্মিত হয়নি। তাহলে যাত্রীদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার প্রকৌশলী হাছান চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে। সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর পর অনুমোদিত হলে আশা করি যাত্রীদের সেবা দিতে পারব।’

মাদক পাচার রোধে চট্টগ্রাম রেঞ্জের পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার মতামত তথা কক্সবাজার রেলস্টেশনে যাত্রীদের আর্চওয়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ এবং ব্যাগ স্ক্যানিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু কক্সবাজার রুটকে ইয়াবা-আইস পাচারের রুট বলা হয়, সেহেতু যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন রেলস্টেশনে বিমানবন্দরের মতোই সুযোগ-সুবিধা রাখা উচিত হবে।’

মাদক পাচারের স্বর্গরাজ্যখাত কক্সবাজার জেলায় নতুন রেলপথ চালুর আগেই নিরাপত্তার স্বার্থে কক্সবাজার রেলস্টেশনে আর্চওয়ে এবং স্ক্যানার বসানো হচ্ছে কি না জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন রেলপথ নির্মাণকাজের প্রকল্প পরিচালক এই বিষয়ে বলতে পারবেন, আপনি তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

এরপর প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েক দিন আগে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তাই আর্চওয়ে এবং স্ক্যানার স্থাপনের বিষয়টি প্রকল্পভুক্ত আছে কি না, তা জেনে জানাতে হবে। এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’

কক্সবাজারে নির্মিত আইকনিক রেলস্টেশনটি অত্যাধুনিক এবং এখানে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরাসহ আধুনিক সব সুবিধা আছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনায় আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে।’

কিন্তু রেঞ্জ পুলিশের পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য খণ্ডন করে বলেন, অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একই বিষয় নয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যায় না। শতভাগ নিশ্চিত করতে হয়। এই কারণে দেশের যুবসমাজকে মাদকাসক্তের কবল থেকে বাঁচাতে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে স্ক্যানার এবং আর্চওয়ে স্থাপন জাতীয় স্বার্থে অতীব জরুরি। আবার আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনায় যাতে নাশকতা না হয়, সেজন্যও নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। সুত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

পাঠকের মতামত

যদি অভাবী হন, চাঁদাবাজি বাদ দিয়ে ভিক্ষা করেন : রফিকুল ইসলাম খান

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, চাঁদাবাজি করা হারাম, ভিক্ষা ...

এমএসএফের প্রতিবেদন৮৪% রোহিঙ্গার আশঙ্কা—মিয়ানমারে ফেরা নিরাপদ নয়

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস/মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ)-এর নতুন একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, মিয়ানমারে চরম সহিংসতার ...